Advertisement
১৯ মে ২০২৪
Students Protest

‘সেইখানে যোগ তোমার সাথে’

ভিডিয়ো ভাইরাল হল। আর যা হয়, মশকরা আর মুগুর দুই-ই জুটল দমাদ্দম। এঁরা কারা! ন্যূনতম রাজনীতিবোধ দূরস্থান, কাণ্ডজ্ঞানটুকু নেই! একটু খুঁড়তেই বেরিয়ে পড়ল বিষাক্ত কেউটে।

শিশির রায়
শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২৪ ০৮:১২
Share: Save:

যখন সময়টা ঠিক সুবিধের নয়, আর ঠিক তা বোঝাতেই যেন হ্যামলেটের বাবার ভূত দেখা দিচ্ছে আশপাশে, ঠিক সেই সময়ই শেক্সপিয়র মার্সেলাসের মুখে বসিয়ে দিয়েছিলেন সেই অমোঘ শব্দগুচ্ছ: “সামথিং ইজ রট্‌ন ইন দ্য স্টেট অব ডেনমার্ক।” কিছু একটা তো পচেছে... কী সেটা? জীবন আর পরিপার্শ্বের সেই পচন খুঁজে বেড়ানো, আবার খুঁজে পেয়েও সিদ্ধান্ত নিতে পারা-না পারার টানাপড়েনই হ্যামলেটের ট্র্যাজেডি, যার ফল ভুগতে হয় তার দেশকেও। ক্ষমতা ও দুর্নীতির পচন এমনই, কাউকে ছাড়ে না।

ডেনমার্ক অবধি যেতে হবে না, পচন ধরেছে ঘরেই। এই সে দিন, গ্রেটার নয়ডার এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ‘খবর হলেন’। কী ব্যাপার? না, তাঁরা মিছিল করে গিয়েছিলেন দিল্লিতে জাতীয় কংগ্রেসের সদর দফতরের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে। হাতে প্ল্যাকার্ড, মুখে স্লোগান। নরেন্দ্র মোদীর প্রচারিত ‘বিকশিত ভারত’-এর স্বপ্ন আঁকা সেখানে, আর ‘আরবান নকশাল’দের ঢিট করার বার্তা, কংগ্রেস-বিরোধিতার সুর। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। গোলমালটা পাকালেন উপস্থিত এক সাংবাদিক, মিছিলের ছেলেমেয়েদের সামনে মাইক বাগিয়ে। কী লেখা আপনাদের প্ল্যাকার্ডে? হিন্দি আর ইংরেজিতেই লেখা, কিন্তু দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা পড়তে, বলতে পারছেন না ঠিক করে। এই যে প্ল্যাকার্ডে ‘আরবান নকশাল’ লেখা, কাকে বলে আরবান নকশাল? উত্তর নেই। আমতা আমতা, বিব্রত লজ্জিত মুখ, অপ্রস্তুত হাসি।

ভিডিয়ো ভাইরাল হল। আর যা হয়, মশকরা আর মুগুর দুই-ই জুটল দমাদ্দম। এঁরা কারা! ন্যূনতম রাজনীতিবোধ দূরস্থান, কাণ্ডজ্ঞানটুকু নেই! একটু খুঁড়তেই বেরিয়ে পড়ল বিষাক্ত কেউটে: এই ছাত্রেরা জানতেন না কিছু, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁদের বলা হয়েছিল কংগ্রেসের দফতরের সামনে মিছিল করে যেতে। কেন? বলা হয়েছিল, ওখানে গেলে কঙ্গনা রানাউতের সঙ্গে দেখা হবে। ফিল্মস্টার বলে কথা! আমরা মূলত অরাজনৈতিক, কিন্তু আমাদের বলা হয়েছিল, ওখানে গেলে ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্টে ফুল মার্কস পাওয়া যাবে। বলা হয়েছিল, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বললে আমরা যে এই সময়ের রাজনীতি নিয়ে ভাবিত, তা বোঝানো যাবে। প্ল্যাকার্ড আমরা লিখিনি, আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। সমাজমাধ্যমে এক ছাত্রী লিখেছেন, “আমাদের ভুল হয়েছে, আমরা বুঝিনি এটা প্রোপাগান্ডা ছিল।”

এই ছেলেমেয়েরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করবেন? করতে পারবেন? আঙুল তুলে বলতে পারবেন: এই যে আপনারা— উপাচার্য, শিক্ষক-সহ গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকবৃন্দ, কী করে পারলেন আমাদের এমন একটা বিচ্ছিরি ঘটনার দিকে ঠেলে দিতে? কিংবা জ্ঞাতসারে বা অজানতে, অলক্ষ্যে বা প্রকাশ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও ‘চালাচ্ছেন’ যাঁরা, তাঁদের বিরুদ্ধে কি একটা মিছিল করতে পারবেন এই ছাত্রছাত্রীরা? একটা সত্যিকারের মিছিল, মূর্খতা ও সুবিধাবাদের অরাজনীতি সরিয়ে একটা দৃপ্ত রাজনীতিবোধ-তাড়িত বিক্ষোভ?

হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে, আমেরিকায় একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সময়ে চলছে এমন এক আন্দোলন, যা পথ দেখাতে পারে এই ছেলেমেয়েদের। হতে পারে সেই আন্দোলনের ‘চাওয়া’টা আরও বড়, অনেক বড়— ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বৈরথ, গাজ়ার ধ্বংসস্তূপ এই মুহূর্তে একটা বৈশ্বিক প্রভাব ফেলা ঘটনা। কিন্তু রাজনৈতিক ‘ইস্যু’র ছোট-বড় বাদ দিয়ে যদি রাজনীতি-সচেতনতার, চার পাশে যা ঘটছে তার প্রেক্ষিতে আমার অবস্থান ও বোধ নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি, তা হলে ভারতের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারতেন, তাঁদের সমস্যাটা কোথায়। অরাজনৈতিক থাকাটা একটা ‘চয়েস’, কিন্তু তাতে এঁদের ক্ষমতার শিকার হওয়া আটকায়নি। বরং যদি চোখকান খুলে-রাখা, রাজনৈতিক সমর্থন বা বিরোধিতার টনটনে নাড়িজ্ঞানটুকু থাকত, তা হলে অকুস্থলে পৌঁছনোর পর অন্য কেউ এসে হাতে প্ল্যাকার্ড তুলে দিচ্ছে, এ স্পর্ধা এঁরা সহ্য করতেন না।

বিশ্ববিদ্যালয় মানেই তো বহুস্বরের কলরব। আমেরিকার না হোক, ঘরের কাছেও সেই বিশ্ববিদ্যালয় আছে, আছেন সমবয়সি ছাত্রছাত্রী, ক্যাম্পাসে ও রাজপথে যাঁদের সমস্বর ঠিক জায়গায় কাঁপন তোলে। তখন কোনও বিশ্ববিদ্যালয়কে দাগিয়ে দেওয়া হয় দেশদ্রোহী বা সংখ্যালঘুর আঁতুড়ঘর বলে, কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের আদ্যক্ষরগুলির উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহারে তৈরি হয় খোঁচাখুঁচির সিনেমা। এই সব, এবং আরও অনেক তথাকথিত বাগড়া অপেক্ষা করে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি-সচেতন ছেলেমেয়েদের জন্য। ক্যাম্পাসে, হস্টেলে এসে মেরে যায় বহিরাগত গুন্ডা, রাজ্য বা রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা প্রকাশ্যভাষণে টার্গেট করেন বিশ্ববিদ্যালয়কে।

হলই বা। ক্ষমতা কলসির কানা ছুড়ে মারলে, প্রত্যুত্তরে কলসির শূন্যগর্ভতা বুঝিয়ে দেওয়াটাই যৌবনের ধর্ম। দেশে-বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ও কাজটা করে থাকেন প্রবল আবেগ ও প্রখর যুক্তির মিশেলে। ভুল করাটাও তার একটা অঙ্গ, আবেগ বা যুক্তির ভুল। তা বলে গোড়ার জিনিসটায় ভুল থাকলে চলবে না। কেউ যেন এসে পাখিপড়া করে যেতে না পারে, “কাল অমুক জায়গায় আয় তো সবাই মিলে, একটা কাজ আছে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE